এগুলো বাজারী কিংবা ফেরী করা মধু নয়। পুরো একশ’ ভাগ খাঁটি। কারণ মৌয়াল মৌয়ের চাকা ভাঙ্গতে তার নিজ চোখে দেখা। বাজারে খাঁটি মধু মেলা ভার। তাই বেশ দূরের এক গ্রাম থেকে এক বয়ম মধু সংগ্রহ করলেন সাবিতের আম্মু।
রোদে দিতে নামাচ্ছিলেন। সাবিত দেখে ফেললো। জিভে পানি বেড়ে যায়। ও বলে ওঠে,
: আম্মু আমাকে এক পেয়ালা মধু দাও-না।
:পাগল নাকি! বলে কি, এই গরমে কেউ এক পেয়ালা মধু খেতে চায়! একদম মারা পড়বে।
আম্মু ভাবলেন, এখন যদি চা চামচে আধ চামচও দেয়া হয়, তবে হয়েছে। স্বাদ পেয়ে আরও খেতে চাইবে। তখন সামলানোর জো থাকবে না। সকালে নাস্তার সঙ্গে পরিমাণমত সবাই মিলে খাওয়া যাবে। এখন থাক।
বেশ পীড়াপীড়ি করছে ও। আম্মু একটুও দিচ্ছেন না। বরং কড়া কন্ঠে বলে ওঠেন, চুপ। এসব আমি একদম পছন্দ করি না।
ও জানে আর এগুনো ঠিক হবে না। এ অবেলায় মধু না জুটে উল্টো অন্য কিছু এসে পড়বে হয়ত। তাই আপাতত ক্ষান্ত হয়। আব্বু অপেক্ষা আম্মুকেই জম ভয় করে সাবিত। কারণ ওর আব্বু যত ঠান্ডা, আম্মু ঠিক তত কড়া।
কি দরকারে জানি মিরপুরে মল্লিকা আন্টির বাসায় গেলেন আম্মু। সাবিত এটাই মস্ত সুযোগ মনে করলো। এখন বাসায় এক দাদু ছাড়া কেউ নেই। দাদু পাশের রুমে নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছেন। নীতি আপুও স্কুল থেকে ফিরতে আরো বেশ ক’ঘন্টা বাকি। আর কি দেরী করা যায়? হ্যাঁ পটাপট নামিয়ে ফেললো বয়মটা। বের করে খাওয়া শুরু করে দেয়।
খাচ্ছে আর ভাবছে, কে যেন বলেছিল, চিনিতে রোগ বাড়ে মধুতে সাড়ে। আব্বু ই তো একদিন আম্মুকে বলল, লাল চায়ে মধু আর লেবুয় দারুন হয়। তুমি কি জান, এক চা চামচ মধুয় কত উপকার? আবার ভিটামিন বি-১,২,৩,৪,৫,৬ এর সব নাকি সিরিয়াললি আছে। উফ্ দারুন মজা! আরও আগে খাওয়া দরকার ছিল। কিন্তু এরি মধ্যে বেজায় কান্ড ঘটে। মানে, হাত ফসকে গেল। ফ্লোরে পড়ে খান খান হয়ে যায় বয়মটি। মধুতে লেপটে যায় ঘরের পুরো মেঝে। ভয়ে সাবিতের বুক মুঠোয় ধরা চড়ুইর মতো টিম টিম করছে। হে আল্লাহ! আজ আর রক্ষে নেই বুঝি!
আরো ছোট বেলা ও একটা বাজে কাজ করতো। হোমিও ঔষধের সুগার বড়ি খাওয়ার লোভে দাদুর শিশি ইচ্ছে করে ভেঙ্গে ফেলতো। সাদা মিষ্টি বড়ি চুষে খেতো। ভাল্লাগতো । আম্মু আব্বু কেউ দেখলেই কেবল হৈচৈ করতো। একজনের ঔষধ আরেক জনে খেলে অনেক ক্ষতি হয় বলে বকাবকি করতো।
জড়সড় অবস্থা। ভাগ্যিস! দাদু এখনো টের পাননি। নেকড়া দিয়ে দ্রুত পরিষ্কারে লেগে যায় সাবিত। বয়ম ভাঙ্গা কাঁচে হাত লাগতেই সহসা কেটে যায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোয়। মধু আর টকটকে লাল রক্তে একসা হয়ে যায়। অন্য সময় হলে অনেক কম ব্যাথায় কান্না কাটিতে পুরো বাড়ি মাথায় তুলতো। কিন্তু এখন কান্না কাকে শোনাবে? দাদুকে জানালেও বিপদ। একটুও বিলম্ব করবে না। আম্মুর আদালতে মামলা আজই ঠুকে দেবেন। ঘটনা দুদিন পর জানলে হয়ত শাস্তি কিছুটা লঘু হবে। এসব অনেক কিছুই মাথায় আসছে সাবিতের। ঠিক তখনি কলিং মিউজিক বেজে ওঠে। ওর হৃদপিন্ডের ধুকপুক যেন আরো বেড়ে গেলো। ঝটপট একদিকে গুছিয়ে কিছু দিয়ে ঢেকে রাখে ওসব।
দরজা খুলে দেয়। না, যা ভেবেছে তা নয়। দেখে, মার্কেটিং এর লোক নতুন শেম্পু, তেল, লোশন সহ নানা প্রডাক্টস বাড়ি বাড়ি নিয়ে দেখাচ্ছে।
: এই তোমাদের লাগবে, নতুন এসছে খুব ভালো এসব?
: না। বললো সাবিত।
ও আনমনা বলে ওঠে,
: মধু আছে?
: ওমা ! আমাদের কাছে মধু আসবে কোত্থেকে? কিছুটা অবাক হয়ে বলে ওদের একজন।
: অ, সরি! আমি একদম ভুলে গেছি।
আবার কি ভেবে ওই যুবকদের অনুরোধ করে বসে সাবিত, আচ্ছা ভাইয়ারা, দয়া করে একজন মধুওয়ালাকে পাঠাবেন? আমার ভীষণ প্রয়োজন মধুর।
: ঠিক আছে। যাবার পথে আমরা দেখছি। তেমন কাউকে পেলে তোমাদের এই বাড়ির ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবো। বলে গেল এক যুবক।
এ শহরে ফেরি করা কোন কিছুই খাঁটি নেই। বিশেষ করে তরল কিছু। আর এখানে কোন কিছু পেতে বেশী দেরীও হয় না। টাকা হলেই মিলে সব। যেন বাঘের চোখ অবধি। ঘন্টাখানেকের মাথায় হাজির হলো মধুওয়ালা। হাতের পাত্র মধুতে টইটম্বুর। ওতে মধু চাকার কিছু অংশ ভাসতে দেখা যাচ্ছে। তার উপর দু’একটা মৌমাছিও নড়াচড়া করছে।
দেখে মনে হচ্ছে যেন এইমাত্র কেটে আনলো। আসলে ছাই। অর্ধেকের বেশি চিনির পানি বা অন্য কিছু মেশানো আছে। যারা অভিজ্ঞ, তারা সহজেই ধরতে পারেন। সাবিতের আম্মু এ সারিতে এক নম্বর। ক’দিন আগে বড় মামা হতে আবদার করে শ’দুয়েক টাকা পেয়েছিল সাবিত। নতুন একটা গল্পের বই কিনবে বলে। সেটা দিয়েই এখন মধু রাখতে যাচ্ছিল, ঠিক আম্মু এসে হাজির। মুখোমুখি হয় মা-ছেলে। একে অপরের দিকে চোখ ছানাবড়া করে চাওয়াচাই করছে। সাবিত চোখ নামিয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। আম্মু চেচামেচি শুরু করার আগেই সাবিত ডুকরে কেঁদে ওঠে অনুগ্রহের আশায় হাত বাড়িয়ে দেখায়, আম্মু এই দেখ! মধু তুলতে গিয়ে বয়ম ভাঙ্গা কাঁচে এমনটি হয়েছে। তুমি আমাকে আর মেরো না। এমনিতেই খুব লেগেছে। আমি আর কক্ষনো অমন করবো না। প্লিজ ! মাফ করে দাও। সাবিতের কাটা হাত দেখে আম্মু কিছুটা হকচকিয়ে যান। ও আড়াল করে রাখায় এতক্ষণ তিনি দেখেননি। না, আম্মু আজ কিছুই করছেন না ওকে। সব অকান্ড বুঝতে পেরে ধৈর্যের বান বাঁধেন তিনি।
ডেকে আনা মধুওয়ালা থেকে সামান্য কয়েক টাকার মধু রেখে বিদায় করে দেন আম্মু। দরজা আটকিয়ে দেন। আর কাটা জায়গা পরিষ্কার করে ওষুধ লাগাতে লাগাতে বলেন, আচ্ছা বল তো, আমি কি তোকে মধু খেতে বারণ করেছিলাম? নিশ্চয়ই না। আমি একটা নির্দিষ্ট সময়ে খেতে বলছিলাম। তোর সইল না। যাকগে, এখনকার রাখা মধু খেয়ে দেখ, কেমন লাগে? ও খেতে চাচ্ছিল না। আম্মুই ওর মুখে পুরে দিয়ে জানতে চাইলেন, এবার বলতো? এগুলো ভাল লাগছে, না নষ্ট করেছিলি যে সেগুলো? ও লাজুকভাবে আঙ্গুল তুলে মাথা ঝাঁকিয়ে জবাব দেয়, নষ্ট করাগুলো। আর ঐ ভালো মধু যদি তুই বেশি পরিমাণ খেতি, তবে এতক্ষণে ডাক্তার বাড়ি দৌড়াতে হতো। কারণ খাাঁটি মধু মাত্রার অধিক খেলে গায়ে জ্বালা-পোড়া ধরে যায়। উপকার না করে উল্টো রি-অ্যাকশন করে বসে। এবার দৃঢ় কন্ঠে বলে ওঠেন আম্মু,
: ভবিষ্যতে আর এমন হবে নাতো?
: না। জড়সড় ভাবে বলল সাবিত।
: হলে, ঐ যে ঝুলানো জালি বেত, সেটা অবশ্যই ব্যবহার করা হবে।
বেতের দিকে তাকাতেই আচম্বিতে ডর বেড়ে যায় সাবিতের। ও কানে হাত দিয়ে বলে ওঠে, এই কান ধরে বলছি আম্মু! আর কখনো অমন করবো না।
: হয়েছে, খুব হয়েছে। আমাকে দেখাতে হবে না। মনের কান ধরে ঠিক থাকলেই চলবে। যাও এখন টেবিলে পড়তে বসগে।
হাপিত্তেস করেন আম্মু, হায় আল্লাহ! আমি এখন আর খাঁটি মধু কোথায় পাই?
এতক্ষণে ঘুমন্ত দাদুও জেগে উঠেছেন। খাঁটি মধুর কথা শুনে দাদু কি আর সইতে পারেন? তারও বুড়ো জিভে পানি এসে যায়। তাই তো দাদুও তার ঘর থেকে লম্বা আওয়াজে বলে ওঠেন।
বৌ মা, অ- বৌ মা ! আমাকে এক পেয়ালা খাঁটি মধুর পায়েস দাও তো ।
– মোসলেহ্ উদ্দীন সা’দী
sadi.musleh97@gmail.com