খেজুর গুড় খেজুর গাছ থেকে নির্গত সুস্বাদু রস থেকে খেজুর গুড় তৈরি হয়। অগ্রহায়ণ মাস থেকে শুরু করে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত খেজুরের রস সংগ্রহ করা হয়ে থাকে এবং সে রসকে ঘন ও শক্ত পাটালিগুড়ে পরিণত করা হয়।
এক সময় এ খেজুরের রস থেকে চিনি তৈরি করা হতো। বৃহত্তর যশোর ও ফরিদপুর জেলা, নদীয়া জেলার কিছু অংশ, বশিরহাট ও সাতক্ষীরা মহকুমায় এবং চবিবশ পরগনায় ব্যাপকভাবে খেজুর গাছের চাষ হতো এবং কিছুটা হতো ফরিদপুর অঞ্চলে। এখনও মূলত এসব এলাকাতেই খেজুরের গুড় বেশি উৎপাদিত হলেও বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই কিছু কিছু খেজুর গুড় পাওয়া যায়।
১৯৪০-এর দশকের প্রথম দিকে চবিবশ পরগনার হাওড়া, মেদিনীপুর এবং ফরিদপুর জেলাগুলিতে এ শিল্পের দ্রুত প্রসার ঘটে। ওই সময়ে প্রতি বছর মোট ১,০০,০০০ টন গুড় উৎপাদিত হতো। উৎপাদিত গুড় নৌকা, স্টিমার, ট্রেন এবং সড়ক পথ দিয়ে ঘাটতি এলাকায় নিয়ে যাওয়া হতো যা বাংলায় অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রাখত। খেজুর গাছ ঘরের আড়া, খুঁটি রূপে ব্যবহূত হয় এবং জ্বালানি হিসেবে ইটের ভাটাতেও এর ব্যবহার ব্যাপক হওয়ায় বিস্তীর্ণ এলাকায় খেজুর গাছ প্রায় উজাড় হওয়ার পথে। এ কারণে খেজুর গুড়ের উৎপাদন বহুলাংশে কমে গেছে।
সাধারণত বসত বাড়ির আশেপাশে, রাস্তার পাশে, জমির চারপাশে এবং কোনো কোনো জমির ভিতর সারিবদ্ধভাবে খেজুর গাছ লাগানো হয়। ১ বিঘা জমিতে ১০০টি গাছ লাগানো যায়। সাত বছরের মধ্যে গাছগুলি ফল ও রস সংগ্রহের উপযোগী হয়ে থাকে এবং ত্রিশ/চল্লিশ বছর পর্যন্ত ফলন দেয়। শীতকালে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের আগে কিছু প্রস্ত্ততিমূলক কাজ করতে হয়। অগ্রহায়ণের শেষের দিকে গাছগুলিকে রসের উপযোগী করে তোলার জন্য গাছের কান্ডের একেবারে উপরের অংশে পাতাসম্বলিত বাকলগুলি ধারালো দা দিয়ে চেঁছে পরিষ্কার করা হয়। স্থানীয় ভাষায় একে ‘গাছ তোলা’ বলে। সাত থেকে আট দিন পরে পুনরায় পরিষ্কার করে আরও সাত/আট দিন পর চাঁছা অংশে বাঁশের নল ও খিল লাগিয়ে এবং তার সম্মুখভাগের নিচে হাঁড়ি ঝুলিয়ে দিয়ে রস সংগ্রহ করা হয়।
সারা মৌসুমে রস আহরণকে ৬ দিন করে কয়েকটি পর্বে ভাগ করে নেওয়া হয়। প্রথম রাতের রসকে বলা হয় জিড়ান, যা গুণে ও মানে সর্বোৎকৃষ্ট এবং পরিমাণেও সর্বোচ্চ। দ্বিতীয় দিন বিকালে ওই গাছের কাটা অংশটুকু (চোখ) পরিষ্কার করা হয় এবং ওই রাত্রের নির্গত রসকে বলা হয় দোকাট। তবে তা জিড়ান-এর মতো সুস্বাদু কিংবা মিষ্টি নয় এবং পরিমাণেও হয় কম। তৃতীয় রাত্রের প্রাপ্ত রসকে বলা হয় ঝরা। ঝরা রস দোকাটের চেয়েও পরিমাণে কম এবং তা কম মিষ্টি ও অনেক ক্ষেত্রে টক স্বাদযুক্ত। পরবর্তী তিনদিন গাছকে অবসর দেওয়া হয়। এরপর আবার নতুন করে চাঁছা (কাটা) ও রস সংগ্রহের পালা শুরু হয়।
একটি মাঝারি মাপের সুস্থ খেজুর গাছ প্রতিদিন গড়ে ৬ লিটারের মতো রস দিয়ে থাকে। আবহাওয়া যত শীতার্ত এবং পরিচ্ছন্ন থাকে রস ততই পরিষ্কার ও মিষ্টি হয়। নভেম্বরের প্রথম দিকে রস আহরণ শুরু হলেও ডিসেম্বর এবং জানুয়ারিতে সর্বাধিক পরিমাণে পাওয়া যায়।
রস সিদ্ধ না করলে তা গাঁজন প্রক্রিয়ায় তাড়াতাড়ি মজে গিয়ে নষ্ট হয়ে যায়। তবে এভাবে মজে যাওয়া খেজুরের রস অনেকে তাড়ি (দেশীয় মদ) হিসেবে পান করে। কোনো কোনো অঞ্চলে তা স্বাস্থ্যবর্ধক পানীয় হিসেবে গরু-মহিষকে খাওয়ানো হয়। কিন্তু একবার একে গুড়ে পরিণত করলে এটি অনেকদিন পর্যন্ত খাওয়ার উপযোগী থাকে। রস থেকে গুড়ে রূপান্তরিত হতে কয়েকটি স্তর পার হতে হয়। গুড়কে আরও একটু জ্বাল দিলে সেটি বেশি ঘন হয়ে যায় এবং চিংড়ি-তে পরিণত হয়। এ চিংড়ি গুড় এক সময় গ্রাম এলাকায় চকলেট হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
যে ব্যক্তি গাছে উঠে তা চাঁছা (কাটা) ও এ থেকে রস সংগ্রহ করার কাজ করে তাকে গাছি বলে। গুড় থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় পাটালি গুড় তৈরি করা হয়। যশোরের খাজুরা বাজার নামক স্থানের বিশেষ ধরনের পাটালি গুড় এবং মাদারীপুরের হাজারী গুড় বিখ্যাত। এখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার লোকজন খেজুরের পাটালি গুড় ক্রয় করতে আসে। খেজুরের রস সংগ্রহ, গুড় বানানো এবং রস বিক্রয় ও গুড়ের ব্যবসাপাতি করে গরিব ও মধ্যবিত্ত লোকেরা জীবিকা নির্বাহ করে।
খেজুর রস খুবই সুস্বাদু। শীতকালে খেজুরের রস ও গুড় দিয়ে পায়েস তৈরি হয় যা গ্রামবাংলার খুবই প্রিয় খাদ্য। এ ছাড়া খেজুরের গুড় দিয়ে বিভিন্ন ধরনের শীতকালীন পিঠা, তালের পিঠা, খেজুর গুড়ের জিলাপি ইত্যাদি তৈরি হয়ে থাকে।